কেরানীগঞ্জের আনাচে কানাচে কেমিক্যাল গোডাউন; আতঙ্কে স্থানীয়রা

কেরানীগঞ্জ

১৩ বছর আগে ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে বিষ্ফোরনে ১২৪ জন নিরীহ মানুষ নিহত হবার পরে পুরান ঢাকার সকল কেমিক্যাল গুদাম কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সরকার। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর আলোর মুখ দেখে নি। এরপরে ২০১৯ সালে চকবাজারে চুড়িহাট্টা ট্রাজেডির পরে প্রশাসন কঠোর ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় পুরান ঢাকার সকল কেমিক্যাল গুদাম কেরানীগঞ্জের নির্দিষ্ট একটি স্থানে স্থানান্তর করে গড়ে তুলা হবে কেমিক্যাল পল্লী। সরকারেরে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলেও চুড়িহাট্টা ট্রাজেডির পরে পুরান ঢাকার অনেক কেমিক্যাল ব্যবসায়ী তাদের গুদামগুলো কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পীত ভাবে স্থানান্তর করে। কোন ধরনের নিয়ম নীতি ছাড়া এসব গোডাউন কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর করায় এখন কেরানীগঞ্জেও কেমিক্যাল গুদামে ঘটছে ভয়াবহ বিষ্ফোরন। স্থানীয় অনেকেই যানেন না তাদের আশে পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভয়াবহ সব রাসায়নিক কেমিক্যালের গুদাম, এতে করে আতঙ্কে রয়েছে স্থানীয়রা।

জানা যায়, ২০১০ সালে জুন মাসের ৩ তারিখে নিমতলী ট্রাজেডীতে ১২৪ জন নির্মমভাবে পুড়ে মারা যাবার পর পরই পুরান ঢাকাবাসী সরকারের কাছে দাবী করে ভয়াবহ সব কেমিক্যালের গুদাম পুরান ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হোক। তাদের এ  দাবীর প্রেক্ষিতে সে সময় সরকার ঘোষনা দেয় পুরান ঢাকা থেকে ক্যামিকেল গুদাম গুলো সরিয়ে কেরানীগঞ্জে নির্দিষ্ট একটা স্থানে গড়ে তুলা হবে ক্যামেক্যাল পল্লী। সেই অনুযায়ী কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা মৌজায় ২০ একর জায়গা ও নির্বাচন করা হয়েছিল কেমিক্যাল পল্লী গড়ে তোলার জন্য।

এ লক্ষ্যে পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকার প্রকল্প ও হাতে নেয়া হয়েছিল তখন। তবে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যাবসায়ীদের আপত্তির মুখে তখন আর এ প্রকল্পটি সামনে আগায় নি।

এরপরে গত ২০ শে ফেব্রুয়ারী ২০১৯ চকবাজারে চুড়িহাট্টা এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনের আগুনে ৭৮ জন নিহত হবারা পরে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ূন ঘোষনা দিয়েছেন, কেরানীগঞ্জে বিসিক এলাকায় গড়ে তোলা হবে কেমিক্যাল পল্লী। পরিকল্পনা করা হয়েছিলো ৫০ একর জায়গায় রাসায়নিক গুদামের জন্য প্রায় ৯০০ টির বেশি প্লট তৈরী করা হবে।

শিল্পমন্ত্রীর ঐ ঘোঘনার পর ঐ বছর ২৩ ফেব্রুয়ারী কেরানীগঞ্জে কেমিক্যাল পল্লীর জন্য জায়গা পরিদর্শনে আসেন ভূমি মন্ত্রনালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব আব্দুল হালিম, বিসিক চেয়ারম্যান মো: মোস্তাক হোসেন, কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহ প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা । পরিদর্শনে এসে তারা কেরানীগঞ্জের কালন্দি ইউনিয়নের ব্রাম্মনকিত্তা মৌযায় ৫০ একর জায়গা প্রাথমিক ভাবে নির্বাচিত করে।

একই বছর ২০১৯ এর ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জে চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম প্লাষ্টিক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে আবারো মুখ থুবড়ে পরে কেরানীগঞ্জে কেমিক্যাল পল্লী গড়ে তোলার প্রকল্প।

তবে সরকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলেও পুরান ঢাকার অনেক কেমিক্যাল ব্যবসায়ী কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় কোন নিয়ম নীতি না মেনেই গড়ে তুলে কেমিক্যাল গোডাউন। এতে করে পুরান ঢাকার মতো কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকাও রয়েছে মারাত্মক কেমিক্যাল বিষ্ফোরনের ঝুকিতে।

কেরানীগঞ্জের অণেক ভবন মালিক মোটা অঙ্কের অর্থের লোভে, বেশি টাকা এডভান্স ও বেশি ভাড়া পেয়ে কোন ধরনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অনেক এলাকায় গোপনে কেমিক্যাল গোডাউন ভাড়া দিয়েছে। এতে করে ঝুকিতে রয়েছে কেরানীগঞ্জের স্থানীয়রা। ভয়াবহ দুর্ঘটনাও ঘটেছে কয়েকবার।

২০২০ সালের ৪ জানুয়ারী কেরানীগঞ্জের জিনজিরা পূর্ব বন্দ ডাক পাড়া এলাকায় রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ বিষ্ফোরনে আশে পাশের পুরো ১ কিলোমিটার কেপে উঠে। কোন ধরনের প্রানহানী না হলেও ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্থ হয় আশে পাশের অনেক বাড়ি ঘড়। এর পরে গত ১৫ তারিখ রাতে কালিন্দি ইউনিয়নে রাসায়নিক কারখানায় ভয়াবহ বিষ্ফোরনে নিহত হয় ৫ জন। এতে করে স্থানীয়দের মনে আতঙ্ক আর উৎকন্ঠা আরো বেড়েছে।

কালিন্দী ইউনিয়নের গদাবাগে যেখানে বিষ্ফোরন ঘটেছে ঐ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মো: মেহেদী বলেন, নিরাপত্তার খাতিরে পুরান ঢাকার কেমিক্যল পল্লী কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়েছে তবে এতে করে কেরানীগঞ্জবাসীর নিরাপত্তা ঝুকির মুখে ফেলে দিয়েছে। গত পরশু দিনের দুর্ঘটনা তার প্রমান। আমরা কেও জানতাম না আমাদের পাশেই এমন ভয়াবহ একটা গুদাম। এমন মতো যদি আবারো দুর্ঘটনা ঘটে এর দায় কে নিবে ? আজকের দুর্ঘটনার দায় ই বা কে নিবে ? প্রশাসনের এসব বিষয়ে নজর দেয়া উচিত।

মো: আবুল হাসান নামে এক ব্যাক্তি বলেন, এভাবে ঘিন্জি এলাকায়, আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউন না দিয়ে রোহিতপুর বিসিকে ধ্বলেশ্বরীর পাশে শত শত একর খালি জমি পরে আছে ঐ খানে করুক। নদীর পাশে হওয়াতে নিরাপদ ই হবে। আর যে সকল মালিকের টাকার লোভে এলাকাবাসীকে ঝুকিতে ফেলছে তাদের কে চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করুক উপজেলা প্রশাসন।

কেরানীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র ফায়ার স্টেশন অফিসার কাজল মিয়া জানান, কেরানীগঞ্জের অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় যাতায়াত ও পানির ব্যবস্থা। কেরানীগঞ্জে বিভিন্ন স্থানে অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে কেমিক্যাল গোডাউন। এসব গোডাউন বন্ধে আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে থাকি। উপজেলা প্রশাসনের এ বিষয়ে কাজ করলে আমরা তাদের পূর্ন সহযোগিতা করবো।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সল বিন করিম বলেন, আমরা কেমিক্যালে গোডাউন কোথায় কোথায় আছে খোজ করতেছি। অভিযান চালাচ্ছি, নিয়ম নীতির বাইরে যারা আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

আরো পড়ুনঃ কেরানীগঞ্জে হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর চাপ