কেরানীগঞ্জ

কেরানীগঞ্জে প্রবেশ মুখে অবৈধ স্ট্যান্ড; ভোগান্তিতে সাধারন জনগন

আগানগর কেরানীগঞ্জ জিনজিরা

*) ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার দখলে কদমতলী গোল চত্বরের সকল স্ট্যান্ড

*) এই সকল অবৈধ স্ট্যান্ড থেকে মাসে আদায় হয় কোটি টাকার উপরে চাদা

*) রাস্তা দখল করে দাড়িয়ে থাকে সাবেক মন্ত্রীর বাস কোম্পানীর একাধিক বাস

*) পদ্মা সেতু হওয়ার পরে কদতমলীতে তৈরী হয়েছে বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানীর কাউন্টার

 

ঢাকা মাওয়া মহসড়কে যাওয়ার জন্য অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ন প্রবেশ মুখ হলো কেরানীগঞ্জের কদমতলী গোল চত্বর এলাকা। মহাসড়কের এই গুরুত্বপূর্ন পয়েন্টে অবৈধ স্ট্যান্ডের জঞ্জালে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিন। অবৈধ এসব স্ট্যান্ড থেকে ওঠা চাদার টাকা যাচ্ছে একাধিক প্রভাবশালী নেতার পকেটে। অভিযোগ রয়েছে ট্রাফিক পুলিশ ভাগ পায় চাদার টাকার। তবে অবৈধ ভাবে গজিয়ে উঠা সিএনজি, বাস, অটোরিক্সা,প্র্রাইভেট কার,লেগুনা স্ট্যান্ডের খেসারত দিতে হচ্ছে কেরানাগঞ্জ বাসী ও পথচারীদের। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সরকারের একের পর এক উদ্যোগ প্রশাংসার দাবী রাখলেও সরকার দলীয় গুটি কয়েক নেতার স্ট্যান্ডবাজির কারনে ক্রমেই গতিহীন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন সড়ক।

 

সরেজমিনে কেরানীগঞ্জের কদমতলী গোল চত্বর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গোল চত্বরের চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন অবৈধ স্ট্যান্ড। এ সব স্ট্যান্ডে দিন-রাতে কয়েকশ গাড়ি সড়ক দখল করে বিভিন্ন জায়গায় দাড়িয়ে থাকে। আর এতে করে মূল সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। এবং তীব্র জ্যামের সৃষ্টি হয়। পদ্মাসেতুর অংশ হিসেবে কদমতলী গোল চত্বর এলাকার সড়কগুলো ফোর লেনে উন্নত করা হলেও, রাস্তায় অবৈধ স্ট্যান্ডের কারনে বাস্তবে এক লেন দিয়েও গাড়ি চলাচল করতে পারে না।

 

পথচারী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতার সুযোগে কদমতলী গোল চত্বরের চারপাশ দখল করে গড়ে ওঠা এসব স্ট্যান্ডের কারনে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট। প্রতিদিন সকালে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয় । অবৈধ এসব স্ট্যান্ডের কারনে মাঝখান দিয়ে রাস্তা সংকুচিত হয়ে যাওয়ার  ঠিক মতো এক লাইনেও গাড়ি যেতে পারে না। আ্যাম্বুলেন্স, জরুরী কাজে যাতায়াতের গাড়িও আটকে থাকে এই যানজটে। এসব স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, পথচারীসহ সচেতন মহল।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কদমতলী গোল চত্বর এলাকায় একাধিক দোকানদার বলেন, গোল চত্বর এলাকায় প্রতিটা মার্কেটের সামনে এমনভাবে প্রাচীর করে সিএনজি, বাস,অটো রিক্সা, প্রাইভেট কার দাড়িয়ে থাকে , কোন কাষ্টমার দোকানে আসতে পারে না। এতে করে ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। এসব স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে তারা কোন ব্যবস্থাও নিতে পারেন না। কারন প্রত্যেকটা স্ট্যান্ড থেকে প্রভাবশালী কোন না কোন নেতা জড়িত।

 

কদমতলী গোল চত্বর এলাকায় দীর্ঘ সময় জ্যামে বসে থাকা মো: আরাফাত নামে এক বাস যাত্রী বলেন, প্রতিদিন অফিস টাইমে এইখানে দীর্ঘ সময় জ্যামে বসে থাকতে হয়। গোল চত্বরের চারপাশ ঘিড়ে যেখানে সেখানে অবৈধ স্ট্যান্ড হবার কারনে এই জ্যামে ভুগতে হয়। এই তো সামনেই বেশ কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ, তাদের চোখের সামনেই সব ঘটছে, অথচ তারা কিছুই করছে না। আসলে তাদের ম্যানেজ করেই চলছে এগুলো।

 

মো: সেলিম নামে অপর এক যাত্রী জানান, পুলিশ আর প্রশাসন চাইলেই এই অবৈধ স্ট্যান্ড আর যানযট নিয়ন্ত্রন করতে পারে। রাস্তা তো জনগনের, সরকারের। কারো পৈত্রিক সম্পত্তি না। অথচ এই স্ট্যান্ডগুলো এমন ভাবে বসাইসে, যে দেখলে মনে হয় , সব এদের পৈত্রিক সম্পত্তি। সরকার রাস্তা বড় করতাসে ঠিকি, রাস্তা যত বড় হইতাসে দখল ও তত বড় হইতাসে। এগুলো আসলে নিয়ন্ত্রন দরকার।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, গোটা কয়েক নেতা নিয়ন্ত্রন করে কদমতলী গোলচত্বরের আশে পাশের স্ট্যান্ডগুলো। প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ টাকা  চাদা কালেকশন করা হয় এই সব স্ট্যান্ড থেকে।

অবৈধ স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রনকারী এইসকল নেতারা নিজেদের লোকজন দিয়ে প্রতিদিন স্ট্যান্ডের গাড়িগুলো থেকে চাদা কালেকশন করে। পরবর্তীতে চাদার ভাগ বিভিন্ন নেতাদের মধ্যে বাটোয়ার করে দেয়া হয়। এমনি প্রশাসনের পকেটেও যায় চাদার এই ভাগ!

কদমতলী থেকে আটি বাজার, কোনাখোলা,রুহিতপুর, শাক্তা, বাস্তা সহ একাধিক সিএনজি স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রন করে ঢাকা জেলা মৎসজীবীলীগ সভাপতি আফজাল হোসেন ডিপটি। মূলত কদমতলী এলাকার সিংহভাগ সিএনজি স্ট্যান্ড ই তার নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। তার পক্ষে চাদা তুলে হানিফ,হিরাসহ একাধিক ব্যাক্তি। অবৈধ স্ট্যান্ডের কারনে রাস্তায় জ্যামজট বৃদ্ধি পাচ্ছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপটি জানান, সারাজীবন ই এইভাবে স্ট্যান্ড চলে আসছে। স্ট্যান্ড ঠিক রাখার জন্য ট্রাফিক অফিসারের লোক আছে, উপজেলার লোক আছে, আমরা চেষ্টা করি কিভাবে এটা ঠিক রাখা যায়।। আর স্ট্যান্ড নদীর ঐ পার চলতেসে এই পার চলতেসে, কোথাও তো থেমে নেই। সবাই চালাচ্ছে তাই আমিও চালাচ্ছি। এটা সবাই জানে।

কদমতলী থেকে হাসনাবাদের উদ্দেশ্যে আসা সিএনজি স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রন করে যুবলীগ নেতা ইয়াসিন। ইয়াসিনের পক্ষে মো: বাসার নামে এক লোক প্রতিদিন সিএনজি চালকদের কাছ থেকে চাদার টাকা কালেকশন করে। ইয়াসিনের সাথে যোগাযোগ করার জন্য একাধিকবার তার মুঠোফনো কল দিলে তিনি ধরেন নি। তার অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায় নি।

গোল চত্বর থেকে ঢাকাগামী সিএনজি স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রন করে সীমা বেগম নামে এক মহিলা নেত্রী

বাইক স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রন করে লেংড়া সুমন নামে এক পরিবহন চাদাবাজ। কদমতলী তে পাঠাও সার্ভিসের ড্রাইভারদের প্রতিদিন ৫০ টাকা এবং প্রতি ট্রীপের জন্য ১০ টাকা করে দিতে হয় লেংড়া সুমন কে। ল্যাংড়া সুমনের পিছনে রয়েছে প্রভাবশালী এক সিন্ডিকেট।

কদমতলী সারা সেন্টারের সামনে রয়েছে আরেকটি সিএনজি স্ট্যান্ড। মোযাম্মেল নামে এক ব্যাক্তি নিয়ন্ত্রন করে এই স্ট্যান্ড। তবে মোযাম্মেলের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি স্ট্যান্ডের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

কদমতলী এলকার রাস্তার বেশির ভাগ অংশ জুড়ে দাড়িয়ে থাকে দুর পাল্লার বিভিন্ন কোম্পানীর বাস। সার্বিক পরিবহন, চন্দ্রা পরিবহন, মাদারীপুর পরিবহন, শরীয়তপুর পরিবহন, গোল্ডেন লাইন পরিবহন সহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির একাধিক বাস রাস্তা দখল করে দাড়িয়ে থাকে। তবে  সার্বিক কোম্পানীর বাস সবচেয়ে বেশি।  জানা যায় সার্বিক পরিবহন মালিক সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান । মূলত তার প্রভাবেই রাস্তা দখল করে এতোগুলো বাস মূল সড়কে দাড়িয়ে থাকে এবং কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। এর পরেই রয়েছে চন্দ্রা কোম্পানীর বাস। মূলত সার্বিক আর চন্দ্রা এই দুই কোম্পানীরই প্রায় ১৫ থেকে ২০ টি বাস কদমতলী এলাকায় প্রতিনিয়ত দাড়িয়ে থাকে। আর তৈরী হয় অসহনীয় জ্যামজট।

রাস্তায় সার্বিক পরিবহনের ৯ টি বাস দাড়িয়ে থাকতে দেখে, এভাবে যাতায়াতের রাস্তায় অবৈধ গাড়ি পার্কিং করে রাখার নিয়ম আছে কি না, জানতে চাইলে সার্বিক পরিবহনের দায়িত্বে কাউন্টারে থাকা মো: সুজন বলেন, নিয়ম আছে তাই রেখেছি। অন্য কোথাও তো রাখি নাই, আমার কাউন্টারের সামনেই রেখেছি। আমাদের ১০ মিনিট পর পর গাড়ি ছাড়ে, গাড়ি কোথায় রাখবো ? তাছাড়া তাতীবাজার থেকে ঘুড়ে আসতে অনেক সময় লাগে, তাই এখানে রাখতে হয়।

সার্বিক কাউন্টারের আরেকটু সামনেই রয়েছে চন্দ্রা কাউন্টার। রাস্তার দুইপাশে তাদের ৭টি বাস দাড়ানো। এইভাবে রাস্তায় অবৈধ ভাবে বাস রাখার নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে  চন্দ্রা কাউন্টারে ম্যানেজার মো: মিযান জানান, না এইভাবে বাস রাখার নিয়ম নাই, আমরা এখন ই বাসগুলো সরিয়ে দিচ্ছি, পরবর্তীতে আর রাখবো না।

এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মামুনুর রশিদ জানান, অবৈধ স্ট্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধে আমরা মাঝে মধ্যেই অভিযান পরিচালনা করি, যখন অভিযান করি তখন তারা সরিয়ে নেয়, আমরা চলে আসলে আবার যেই সেই হয়ে যায়। এ বিষয়টা ট্রাফিক পুলিশের দেখা দরকার।

ঢাকা জেলা ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) পিযুষ সরকার বলেন, অবৈধ স্ট্যান্ডের সাথে ট্রাফিকের কেও জড়িত নয়। আমরা নিয়মিত গাড়ি রেকার করছি, গতকালকেও ৬০ টা গাড়ি রেকার করেছি। তবে একটা ডাম্পিং স্টেশন থাকলে ভালো হতো।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান, ফয়সল বিন করিম জানান, অবৈধ স্ট্যান্ডের সাথে উপজেলার কেও জড়িত নয় । এই ব্যাপারে আমরা আগে অভিযান করেছি, আবারো অভিযান করবো, রাস্তায় কোন অবৈধ স্ট্যান্ড থাকতে পারবে না।

আরো পড়ুনঃ কেরানীগঞ্জে হত্যাকান্ডরে বিচারের দাবীতে মানববন্ধন