বিশেষ প্রতিবেদক
দেশে এক সময় ড্রাইভিং লাইসেন্স করার এক মাত্র অফিস ছিল মিরপুরে। কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) একে একে ঢাকার মধ্যেই আরও চারটি শাখা চালু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সর্বশেষ ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো-৪ সার্কেলের কার্যক্রম শুরু করা হয়। ঢাকার মধ্যে সেবা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এই শাখা খুললেও অন্য সার্কেলের অফিসগুলোর মতো নতুন এই সার্কেলেও ভোগান্তির শেষ নেই গ্রাহকদের। এখানে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদেরও দালালের কাছে জিম্মি থাকতে হয় বলে জানিয়েছেন।
দালাল দিয়ে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে অন্য সার্কেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেলেও এই সার্কেলটি জমজমাট না হওয়ায় প্রতিটি লাইসেন্সের জন্য এখানে খরচ হয় ১২ হাজার টাকার মতো। আর যদি কেউ শুধু মাত্র ফিল্ড টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করতে চায় তাহলে তাকে গুনতে হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। যদিও সরকারি হিসাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে পেশাদারের জন্য ৩ হাজার ৮০০ অপেশাদারের জন্য ৫ হাজার ৫০০ টাকার মতো লাগার কথা।
খোজ নিয়ে জানা যায়, চালু হওয়ার ১৬ মাস পার হয়ে গেলেও এখানে এখনো ভালো যোগাযোগের ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। কার্যালয়ের সামনে টাকা জমা দেওয়ার জন্য নেই কোন ব্যাংক। ফলে সেবা প্রার্থীদের নানা রকম ভোগান্তির মধ্যেই চলছে এই সার্কেল অফিসের কাজ। তবে অফিস নতুন হলেও সেই পুরনো সিস্টেমেই চলছে অনিয়ম। সরকার নির্ধারিত ফি দিয়ে কোনো কাজই করা সম্ভব হচ্ছে না। কার্যালয়টির সামনেই সক্রিয় কয়েকটি দালাল চক্রের মাধ্যমে করতে হয় সব কাজ। নতুন সার্কেল হওয়ায় অন্য সার্কেলের দালালরাও এখানে সক্রিয় রয়েছে।
সম্প্রতি কয়েক দফায় বিআরটিএর পূর্বাচল কার্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, সার্কেলটি নতুন হওয়ায় অন্য সার্কেল অফিসগুলোর মতো এখনো জমজমাট হয়নি। এখানে ব্যাংক না থাকায় টাকা জমা দিতেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সেবা প্রার্থীদের। কার্যালয় ঘিরে প্রকাশ্যেই দালালদের আধিপত্য দেখা যায়। আইসক্রিম বিক্রেতা সেজেও বাড়তি টাকার বিনিময়ে সব কাজ করে দিচ্ছেন এখানকার দালালরা। পরীক্ষা দিতে যাওয়া লাইসেন্স গ্রাহকদের বসার সু-ব্যবস্থা নেই। তীব্র গরমের মধ্যেই দিতে হয় ফিল্ড পরীক্ষা। ভাড়া করা জায়গায় হ-য-ব-র-ল অবস্থায় চলছে এই কার্যালয়ের কার্যক্রম।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, নতুন সার্কেল হওয়ায় এখানে পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলক অন্যন্য সার্কেলের চেয়ে কম। পরীক্ষা হয় সপ্তাহে একদিন। এখানে পরীক্ষা দেওয়া ৭০ ভাগের বেশি পরীক্ষার্থী ফেল করেন। তবে যারা দালালের শরণাপন্ন হন তারা দিনে ফেল করলেও রাতে ঠিকই পাশ করে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফিল্ড পরীক্ষায় ফেল করেন আমিনুল ইসলাম নামের এক প্রার্থী। পরে রাতে দালালকে ৫ হাজার টাকা দিলে তাকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়। এই কাজে জড়িত আছে এই সার্কেলের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। এই শাখায় পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেন মোটরযান পরিদর্শক অসিম পাল। ফিল্ড টেস্টও তিনি নিয়ে থাকেন। তার বিরুদ্ধে ইচ্ছে করে ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তোলেন আমিনুলসহ আরোও একাধিক পরীক্ষার্থী।
যদিও এই বিষয়ে এই মোটরযান পরিদর্শক অসীম পাল সাংবাদিকদের বলেন, কেউ যদি গাড়ী চালাতে না পারে তাহলে তাকে কিভাবে পাশ করাবো? দিনে ফেল রাতে কিভাবে পাশ হয়ে যায় এই বিষয়ে প্রশ্নে করলে তিনি বলেন, এটা হওয়ার তো কোন সুযোগ নেই। এর বেশি কিছু তো বলতে পারবো না।
সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ভবনটির সামনে চায়ের দোকানগুলোতেই থাকেন কয়েকজন দালাল। তুহিন, আশরাফ, মো. ইমরানসহ একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে এই কার্যালয়। তবে বাবুল নামের উত্তরার আরেক দালালও এই সার্কেল এর কাজ করে দেয়। তবে এজন্য অন্য দালাল থেকে তাকে বাড়তি টাকা দিতে হয়।
মো. ইমরানের সাথে পরিচয় গোপন করে যোগাযোগ করেন এক সাংবাদিক। তিনি বলেন, সব রকম কাজ করা হয়। এক এক কাজের জন্য এক এক রেট। শুধু মাত্র ফিল্ড পরীক্ষায় পাশের জন্য ৪ হাজার টাকা দিতে হবে। বাকি কাজগুলোর জন্য আলাদা টাকা দিতে হবে। আর একবারে সব কাজ করালে ১২ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলেন এই দালাল।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ওমর বলেন, বাইক আগে থেকেই ভালো চালাতে পারি। সব পরীক্ষায় পাশ করলেও এখন ফিল্ডে ফেল করিয়ে দিলো। আগেই দালাল না ধরে আমার ভুল হয়ে গেছে। দালাল ধরলে ঠিকই পাশ করে ফেলতাম। সামনে দালাল ধরবো। তা না হলে এখানে পাশ করা সম্ভব না।
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায় গত মার্চ মাসেও ৫৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন নিহত ও ১ হাজার ২২৮ জন আহত হন। সড়কে এত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির অন্যতম প্রধান কারণ দক্ষ চালকের অভাব। আর বিআরটিএর মতো সংস্থা থেকে যখন অদক্ষ চালকদের লাইসেন্স দেওয়া হয় তখন দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কারণ একটা ড্রাইভিং লাইসেন্সের সঙ্গে অনেকের জীবন জড়িত। টাকার বিনিময়ে যাকে-তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না। বরং দুর্ঘটনা বাড়তে থাকবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিআরটিএ যে পদ্ধতিতে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়, তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অদক্ষ চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ফলে সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। বিআরটিএর সংস্কার লাগবে। সংস্কার ছাড়া এ পদ্ধতি থেকে বেরোনো যাবে না। যেভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয় তাতে দক্ষ চালক পাওয়া যাবে না। তাছাড়া, যাদের বিরুদ্ধে অতিতে অভিযোগ আছে তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে শুধু সার্কেল বাড়িয়ে সেবার মান বাড়ানো যাবে না।
অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ঢাকা মেট্রো-৪ সার্কেলের উপপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) পারকন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব জায়গা নেই। ভাড়া করা ভবনে সেবা কার্যক্রম চালাতে হয়। এক বছর শেষ হলো মাত্র। নানা সংকট রয়েছে সেগুলো সমাধান হলে সেবার মান আরও বাড়বে। আর যে অভিযোগগুলো কথা বলছেন সেগুলো যদি কারো বিরুদ্ধে প্রমাণ পাই তাহলে অবশ্যই ইন্টারনাল তদন্ত করে এখানকার যে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া নির্বাহী মাজিস্ট্রেট এর নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং থাকে এই সার্কেল। কোথাও কোন অনিয়ম হলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।
আরো পড়ুনঃ হজযাত্রীরা সঠিক সময়ে সঠিক ভিসা নিয়েই যাবেন: ধর্মমন্ত্রী