আগুন

রাজধানীতে ১৪ বছরে যত ভয়াবহ অগ্নি ট্র্যাজেডি ঘটেছে

জাতীয়

প্রতিবেদকঃ মোঃ রাহাত  হোসেন

রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর এবার রাজধানীর অগ্নি ট্র্যাজেডি এর খাতায় যুক্ত হলো বেইলি রোড। গত ১৪ বছরে ঘটে যাওয়া এ চারটি ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে আনুমানিক ২৬৮ জনের।  অন্যদিকে মগবাজারে ভবনে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় ১২ জনের। এছাড়া বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ গত কয়েক বছরে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর প্রতিবার আগুন লাগার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। আশ্বাস  দেওয়া হয়, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু বাস্তবে এখন পযন্ত আমরা খুব একটা পরিবর্তন দেখতে পাই নি।

আগুন

নিমতলী ট্রাজেডি: ২০১০ সালের ৩ জুন রাত ৯টার দিকে পুরান ঢাকার চানখাঁরপুলের নিমতলীতে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ধরে যায় পাশের কেমিক্যালের গোডাউনে। মুহূর্তেই দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যালে ঠাসা ঐ এলাকার বেশ কয়েকটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। যখন ভয়ংকর  সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, ততক্ষণে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান ১২৪ জন। আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা। নিমতলী  ট্রাজেডি আলোড়ন ফেলেছিল দেশ জুড়ে। আগুনে পুড়ে এত সংখ্যক মৃত্যু যা চিরকালে দেখেনি বাংলাদেশ।

নিমতলী দুর্ঘটনার পর আবাসিক এলাকা থেকে সব ধরনের রাসায়নিক পদার্থের দোকান, গুদাম ও কারখানা অপসারণ করার কথা ছিল। কিন্তু সেই ঘটনার ১৩ বছর পার হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।অপরদিকে পুরান ঢাকায় আরো আগুন লেগেছে, হতাহত হয়েছে। অথচ সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়  পুরান ঢাকার অধিকাংশ বাড়িতে বাড়িতে এখনো রয়েছে কেমিক্যাল গুদাম।

চুড়িহাট্টা ট্রাজেডি: ২০১৯ সালের ২০  ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা  কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে, যা ছড়িয়ে পড়ে সড়কে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেট কার, রিকশা, ঠ্যালাগাড়ি ও মোটরসাইকেলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। আগুন লাগার ১৪ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। তার আগেই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ৬৭ জনের। পরে মৃতের সংখ্যা  বেড়ে দাঁড়ায় ৭১। এতে আহত হন কয়েক শ মানুষ।

চুড়িহাট্টা  অগ্নি ট্র্যাজেডি পাঁচ বছর পার হয়েছে। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ড  থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর এখনো দিন কাটে সেই রাতের ভীষণ ভয় মাথায় নিয়ে। কিন্তু  বাস্তবে খুব একটা বদল হয়নি। এখনো পুরান ঢাকার অনেক বাসার নিচে কেমিক্যালের গুদামও রয়েছে,চলছে দেদারসে ব্যবসা।
এফআর টাওয়ার ট্রাজেডি: রাজধানীর বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে গত পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুর ১টায় লাগা আগুনে ২৭ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়। ২২ তলা ঐ ভবনের অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডের পর আগুন যখন দ্রুত অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন ভবনের ভেতর আটকাপড়া অনেকে ভবনের কাচ ভেঙে ও রশি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন।

এ সময় কয়েক জন  নিচে পড়ে মারা যান। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছিলেন সেদিন। হেলিকপটার দিয়ে গুলশান-বনানী  লেক থেকে পানি সংগ্রহ করে ভবনে ছিটানো হয়।

অগ্নিকাণ্ডের জন্য ভবনের অনুমোদন, নকশার ত্রুটি ও অগ্নিনিরাপত্তাকে দায়ী করা হয়। ঐ ঘটনায় নড়েচড়ে বসে সরকার। নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনের তালিকা তৈরি করে রাজউক। কথা ছিল, সেই তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। ভেঙে ফেলা হবে সব নকশাবহির্ভূত অবৈধ স্থাপনা।

কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার থেমে যায় সব উদ্যোগ ও পরিকল্পনা। এখন আর কেউ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে কথাও বলেন না কিংবা মাথা ব্যথাও নেই। শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমেও  প্রকাশ করা হয়নি সেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা। অভিযানও চালানো হয়নি নকশাবহির্ভূত কোনো ভবনের বিরুদ্ধে।

মগবাজারের বিস্ফোরণ: গেলো তিন বছর আগে ২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণ হয়। আড়ংয়ের শোরুম ও রাশমনো হাসপাতালের উলটো দিকের মূল সড়ক লাগোয়া সেই ভবন। ঐ ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক ব্যক্তি। বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই বিকট ছিল যে, প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, এমন বিকট আওয়াজ তারা আগে কখনও কোথাও শোনেননি।

ফায়ার সার্ভিস ও  প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ বলেছেন, শর্মা হাউজ নামে ফুডশপে গ্যাস জমে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই ট্রান্সফরমারের কথা বলেছেন।

কিন্তু ঐ ঘটনার প্রায় তিন বছর হয়ে এলেও মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে বলে শোনা যায়নি আজও। বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলার তদন্তভার পাওয়া পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ছয়টি সরকারি সংস্থা তদন্ত করেছে। এর মধ্যে চারটি সংস্থা সিটিটিসিকে সহযোগিতা করছে না।

আর ঘটনার পর পরই ভবনটির ভেতরে ত্রুটিপূর্ণ লাইন থেকে নির্গত গ্যাস থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে বলে ঐ সময় বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্তে উঠে এসেছিল।

বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটে আগুনঃ ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। সেদিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গত ১১ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।

তারা বলেছে, মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এই ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকার।

ফায়ার সার্ভিস গঠিত তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণও প্রায় একই রকমের। তারা বলছে, মশার কয়েলের আগুন বা বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত।

অন্যদিকে ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে ২২৬টি দোকান পুড়ে গেছে। মার্কেটের মালিক সমিতি বলছে, আগুনে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শটসার্কিট) থেকে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি।

 বেইলি রোডে আগুনঃ  রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বেরিয়ে আসছে নানা অনিয়ম। আটতলা আবাসিক বাণিজ্যিক ভবনে ছিল না রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন। অথচ প্রায় প্রতিটি তলাতেই ধুমধামে চলেছে নামিদামি আটটি রেস্টুরেন্ট।

শুধু গ্ৰিন কোজি নয় বেইলি রোডের আশ-পাশের সকল ভবনের প্রায় একই অবস্থা। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে এগুলোর সাজসজ্জাও হয়েছিল খুবই দাহ্য উপকরণে। শুধু তাই নয়, যে ২২ শর্তে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের অনুমোদন দিয়েছিল, তার একটিও কেউ অনুসরণ করেনি। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তিন দফায় এসব নিয়ে নোটিশ দিলেও আমলে নেননি ভবন মালিকরা।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বেইলি রোডের এই ভবনটিতে এতগুলো রেস্তোরাঁ বসানোর বৈধতা ছিল না, ফায়ার সার্ভিস তাদেরকে নোটিশও দিয়েছিল, কিন্তু ভবন মালিক আর কোনো ব্যবস্থায় নেয়নি। সুযোগ ছিলো ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে ভবনের অবৈধ ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার, কিন্তু তারা চিঠি দিয়েই খালাস।

আগুন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দেখার দায়িত্বে আছে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, ডিপিডিসি, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, বিস্ফোরক অধিদপ্তর। সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা এগুলো দেখেও না দেখার মতো থাকেন।

রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জন নিহত হয়েছেন। দগ্ধ ১২ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ভবনটিতে ২টি লিফট ও একটি সরু সিঁড়ি ছিল। তবে জরুরি ফায়ার এক্সিট ছিল না। ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ও লোকজন বের হওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বেশি প্রাণহানি ঘটেছে।

আরো পড়ুনঃ ২০২৪ বিপিএলে কে কোন পুরস্কার পেলেন?