ব্যবসায়ী বিল্লালের মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি হত্যাকাণ্ড!

কেরানীগঞ্জ শুভাড্যা

• ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্ট্রোক বলে চালিয়ে দেয়া

• লাশ গোসলের পরেও নাক দিয়ে ঝরছিল রক্ত

•তড়িঘড়ি করে দাফন

 

 

ঢাকার দক্ষিন কেরানীগঞ্জ থানার শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চুনকুটিয়া এলাকার বস্র ব্যবসায়ী মো. বিল্লালের মৃত্যু নিয়ে এলাকাবাসী ও বিল্লালের শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাঝে তৈরী হয়েছে চাঞ্চল্যতার। গত ১২ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) বিল্লালের মৃত্যুর খবর শুনা মাত্রই শোকের ছায়া বিরাজ করার পাশাপাশি বিল্লালের মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিভিন্ন রকম সন্দেহজনক প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দেয় বিল্লালের শুভাকাঙ্ক্ষীদের মনে।

 

জানা যায়, বিল্লাল ব্যাক্তি হিসেবে ধর্মপ্রাণ ও হাসিখুশি মানুষ ছিলো। আবদুল আলী ও শামীমা বেগম দম্পত্তির ছয় সন্তানের মাঝে বিল্লাল ছিলো চতুর্থ। বিল্লালের বাড়ি শুভাঢ্যা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড শুভাঢ্যা মধ্য পাড়া গ্রামে। বিল্লালের সাথে তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে পারিবারিক ঝামেলা হওয়ায় কয়েকমাস আগে বিল্লাল তার স্ত্রী স্বর্ণা আক্তার ও দুই পুত্র সন্তান মোহাম্মদ(৯) ও আহম্মদ(৭) কে নিয়ে চুনকুটিয়ার একটি বাড়ির ৪ তলায় ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন।

 

চাঞ্চল্যতার সৃষ্টি হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) বিল্লালের মৃত্যু নিয়ে তার সহপাঠী ও এলাকাবাসীর করা একটি মানববন্ধনে। মানববন্ধনে বিল্লালের শুভাকাঙ্ক্ষীরা বিল্লালের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেন, তারা তার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে চেয়ে সঠিক তদন্ত করার দাবী করেন রাষ্ট্রপক্ষের কাছে। মানববন্ধনে বিল্লালের সহপাঠী অ্যাডভোকেট রিয়াদুল ইসলাম বলেন, ছাত্রজীবনে খুব মেধাবী ছিল আমাদের বন্ধু বিল্লাল। পড়াশোনা শেষ চুনকুটিয়া চৌরাস্তায় কাপড়ের ব্যবসা করে স্বাভাবিকভাবেই জীবন যাপন করছিল। তার মোহাম্মদ(৯) ও আহম্মদ(৭) নামে দুটি পুত্র সন্তান রয়েছে। সেদিন হঠাৎ বিল্লালের মৃত্যু খবর শোনে তার স্ত্রী ও ভাইকে ফোন দিলে পরে কথা বলবো বলে কেটে দেন। বাড়িতে এসে লাশ দেখতে চাইলেও দেখতে দেয়নি তার পরিবারের সদস্যরা। পুলিশ-প্রশাসনকে না জানিয়ে তড়িঘড়ি করে বিল্লালকে দাফন করেন। যিনি বিল্লালের মরদেহ দাফনের পূর্বে গোসল করিয়েছে তিনি এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলতে নারাজ। এমনকি তার পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্নিত ছিলো বলে জানান তিনি। তবে এ হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে পরিবারের লোকজন স্বাভাবিক মৃত্যু বলে নাটক সাজানো হয়েছে দাবি এ সহপাঠীর।

 

বিল্লালের আরেক সহপাঠী সোহাগ সাব্বির বলেন, “আমরা যখন বিলাল্লের লাশটা দেখলাম তখন তার মুখের দুইপাশে এবং গলার নিচের অংশে কিছু ক্ষত চিহ্ন ছিলো। বিল্লালের স্ত্রী এবং তার ভাইরা দাবী করছেন যে তার মৃত্যু হয়েছে স্ট্রোকে। কিন্তু তারা তো বিল্লালকে কোন হাসপাতালে নিয়ে যায়নি তাহলে তারা কিভাবে নিশ্চিত হলো বিল্লাল স্ট্রোকের কারণে মারা গেছে! আর যদি তাই হবে তাহলে তার শরীরে এমন ক্ষত চিহ্নগুলো কিসের! নিশ্চই বিল্লালের সাথে ধস্তা ধস্তি হয়েছে। এছাড়াও বিল্লালের মৃত্যু যদি তার স্ত্রী ও পরিবারের দাবী অনুযায়ী সকাল ৭টার পরে হয়ে থাকে তাহলে তার দেহ এতো অল্প সময়ে শক্ত হলো কিভাবে?? আমাদের সন্দেহ বিল্লালের স্ত্রীই তাকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করেছে। ”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে, চুনকুটিয়া চৌরাস্তা এলাকায় এক জমি ব্যবসায়ী জানান, আমরা বিল্লালের মৃত দেহ গোসলের পরেও তার গাল থেকে রক্ত বের হতে দেখি। এটা কোনো ভাবে স্ট্রোকে মৃত্যু হতে পারেনা। বিল্লালের রহস্যজনক এই মৃত্যুর সঠিক তদন্ত করা উচিত বলেও মনে করেন এই ব্যবসায়ী।

 

বিল্লালের মৃত দেহের গোসল কাজ সম্পূর্ন করা মুফতি ইমরান জানান, বিল্লালের মৃতদেহ গোসল করানোর সময় অনেক শক্ত হয়েছিল। তার ঠোটে ও চেহারায় জখমের চিহ্ন ছিল গলায়ও কালো দাগ ছিলো। আমার কাছে খুব আশ্চর্য লেগেছে যে স্বাভাবিক ভাবে মানুষ মারা গেলে তো এরকম হওয়ার কথা না। যেহেতু তার পরিবারের লোকজন কিছু বলে নাই তাই আমিও স্বাভাবিক ভাবে গোসল সম্পূর্ণ করি। তবে আমার কাছে খুব রহস্যজনক মনে হয়েছে।

গোসল সম্পূর্ণ করার কাজে মুফতি ইমরানের সহকারি মো. আলামিন বলেন, যখন লাশ বিল্লালের চুনকুটিয়া বাসা থেকে নামিয়ে আনা হয় তখনো আমি ছিলাম সেখানে। ওইখানে তার মৃতদেহ হাত পা ছড়ানো অবস্থায় বিছানায় পড়া ছিলো।তার স্ত্রী সেটা গামছা দিয়ে বেধে সোজা করে রাখার চেষ্টা করেছিল। তখন স্বাভাবিক ভাবে আমরা ভেবেছিলাম অনেক সময় মানুষ মারা গেলে হাত পা বেকে থাকে, হয়তো এমনি কিছু তাই গামছা দিয়ে বেধে রেখেছে। আমি আবার দেখলাম যে তার চেহারায় গলায় স্পট, আমি দেখে তার বড় ভাইকে বললাম এভাবে লাশ ফেলে রাখসেন, হাসপাতালে নিয়ে যান না কেনো! তার চেহারায় আর গলায় যে স্পটগুলো এগুলো কিসের ভাই? সে আমাকে বললো বিল্লাল ভাই হেফাজতে ইসলামের একটা সমাবেশে গিয়েছিলো। সেখানে একটা ঝামেলায় সে মাইর খাইসে। তবে সাথে সেদিন হেফাজতে ইসলামের প্রগামে যাওয়া রিপন ভাই এর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে ওইখানে এমন অনাকাংখিত কোন ঘটোনাই ঘটে নাই। বিল্লালের মাইর খাওয়া ত দূরে থাকুক… তার নাকের পাশে, গালে, ঠোটে অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন ছিলো। আবার তার গলায় নিচের দিকটায় চিকন গোল করে পুরো গলায় দাগ পড়া ছিল। এমনকি আমরা যখন তাকে গোসল দিচ্ছিলাম সেই সময় ও গসলের পরেও তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলু আর তার চেহারা টা কালো হয়ে গিয়েছিলো। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিলো যে তার মৃতদেহ এতো শক্ত আর হাত পা গুলো কুক্রানো কেন হয়ে গেল। তবে ওঁই পরিস্থিতে তার পরিবারকে তো জোড় দিয়ে কিছু বলাও যায় না, কিন্তু তার বড় ভাইয়ের সাথে এসব বিষয়ে অল্প কথা বলে আমার কাছে কেন যেন তার মৃত্যু টা অনেক রহস্যময় মনে হচ্ছে। এবং যারাই লাশ টা দেখেছে সবাই ধারণা করছে যে বিল্লাল ভাইয়ের স্ট্রোকে কিংবা স্বাভাবিক ভাবে কোন মৃত্যু হয় নাই।

 

চুনকুটিয়ার পল্লি চিকিৎসক মো নজরুল জানান, সেদিন সকালে আমার কাছে খবর আসে যে বিল্লালের শরীর নাকি অনেক খারাপ, কথা বলেনা। খবর পাওয়া মাত্র আমি তার বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ঘরের ভেতর অনেক লোকজন জড় হয়ে আছে। খাটের উপর বিল্লাল শুয়ে আছে। আমি প্রাথমিক ভাবে প্রথমে তার পরিক্ষা করে চেকাপ করে দেখলাম তার হ্রিদস্পন্দনও হচ্ছেনা রক্তচলাচল পরিক্ষা করে দেখলাম রক্ত চলাচলও হচ্ছেনা। এরপর আমি তার স্ত্রীকে বললাম সময় নষ্ট না করে হাসপাতাল নিয়ে যান। যদিও আমি বুঝতে পেরেছি বিল্লাল মৃত, তবুও হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললাম কারন সেখানে গেলে অন্তত তার মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। কিন্তু তার স্ত্রী তাকে হাসপাতাল না নিয়ে সে সময় বললো তার ভাই আসছে, তারা আসলে নিয়ে যাবে। পল্লি চিকিৎসক নজরুলের সাথে আসা চুনুকুটিয়া এলাকার মুদি দোকানী পলী বেগম দাবী করেন, বিল্লালের মৃত্যু রহস্যজনক। তার গলার দুই পাশে গোল করে দাগ ছিল। ওইখানে যারাই ছবি তুলতে যাচ্ছিল বিল্লালের স্ত্রী কৌশলে হাত দিয়ে গলার দাগ ঢেকে রাখার চেষ্টা করছিল। তার স্ত্রীকে ভালো ভাবে জিজ্ঞাসা করলেই বিল্লালের মৃত্যুর কারন জানা যাবে।

 

মৃত বিল্লালের স্ত্রী স্বর্ণা বেগমের সাথে যোগাযোগ তিনি জানান, সকাল ৭টা বাজে আমি ইবনে সিনা হাসপাতালে টেস্ট করতে যাই। আমি ফিরে এসে বিল্লালকে দরজার বাইরে থেকে ওকে কল করলে ও অনেক ডাকাডাকি করলেও সে দরজা না খুললে দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে দেখি বিল্লাল স্বাভাবিক ভাবে যেমন শুয়ে থাকে তেমন অবস্থায় শুয়ে ছিল। ও স্ট্রোক করে মারা গেছে এখানে কোন রহস্য নাই। হাসপাতালে না নিয়ে কিভাবে স্ট্রোকে মারা গেছে নিশ্চিত হয়েছেন জানতে চাইলে সে কোন উত্তর দিতে পারেনি। বিল্লালের শরীরে থাকা ক্ষত চিহ্নের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিল্লাল অনেক সময় মিছিল মিটিং এ যেতো, কাধে করে মাল নিয়ে আসতো। তার অনেক জ্বর ছিলো শরীরে, ঠোটে একটা জ্বর ঠোসার চিহ্ন ছিলো।

বিলাল্লের বড় ভাই দুলালের সাথে কথা হলে তিনিও একই উত্তরে বলেন বিল্লাল স্ট্রোক করে মারা গেছেন। সে আমাদের সাথে থাকতো না। বিল্লাল ও বিল্লালের স্ত্রীর মাঝে অনেক ভালো সম্পর্কও ছিলো। আমার মনে হয়না তাদের মাঝে কোন সমস্যা হয়েছিলো। বিল্লালের কিছু ব্যাবসায়ীক ঋণ ছিলো, হতে পারে এসবের চিন্তায়ই সে স্ট্রোক করে মারা গেছেন বলে ধারনা আমার।

 

মৃত বিল্লালের সহপাঠী, এলাকাবাসি ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের দাবী অতি দ্রুততম সময়ে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বিল্লালের মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করা হোক।