কেরানীগঞ্জে গৃহবধূ আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলার আসামিকে বাঁচাতে পুলিশের টালবাহানার অভিযোগ

আইন ও আদালত কেরানীগঞ্জ ছিনটাই ও অপরাধ

ঢাকার কেরানীগঞ্জে গৃহবধূ মোর্শেদা আক্তার ঊর্মি (২৫) নিহতের ঘটনায় করা আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলায় আসামীদের বাঁচাতে  নানান টাল বাহানার অভিযোগ উঠেছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশের বিরুদ্ধে।  নিহতের পরিবার দাবি করছে, আসামি পক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ করে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক ও অলিনগর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ সুব্রত দাস ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছে।  পাশাপাশি, মামলার এজাহার এবং নথিতে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সংযুক্ত করার অভিযোগও উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

 

নিহতের পরিবারের কাছ থেকে জানা যায়, গত ২৬ জানুয়ারি মোর্শেদাকে অচেতন অবস্থায় তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা সেখানে পৌঁছে মোর্শেদাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।

 

এ ঘটনায় নিহতের বাবা বিল্লাল গাজী দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় মোর্শেদার স্বামী সজিব খান (২৫), দেবর রাজিব খান (২১), ভাসুর আরিফ খান (৩০) ও শাশুড়ি পিয়ারা বেগম (৫০) কে আসামি করা হয়।  তবে মামলা দায়েরের পর নয়দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।  এতে করে তাঁদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।  এ ঘটনায় ৩ ফেব্রুয়ারী সোমবার নিহতের পরিবার সংবাদ সম্মেলন করে দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার ও সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের দাবি জানান।  সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি র‍্যাব-১০ এর নজরে আসলে, র‍্যাব ১০ এর একটি আভিযানিক দল তথ্য প্রযুক্তির ও র‍্যাব-৮ এর সহযোগিতায় বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গাজিপাড় এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মোর্শেদার স্বামী সজিব খানকে দুই দিনের ভেতর গ্রেপ্তার করে।

 

নিহতের বাবা বিল্লাল গাজী বলেন, তিন বছর আগে বরিশালের উজিরপুর থানার কেশবকাঠি গ্রামের হাবিব খানের ছেলের সাথে মেয়ে মোর্শেদা আক্তারের বিয়ে হয়।  বিয়ের পর থেকেই মোর্শেদার স্বামী সজিব, তাঁর মা পিয়ারা বেগম, দেবর রাজিব, ননদ শিউলি ও ভাসুর আরিফ যৌতুকের জন্যে মোর্শেদাকে মারধর ও নির্যাতন করতো। মেয়ের সংসারের কথা চিন্তা করে সজিবকে কয়েক ধাপে আট লাখ টাকা যৌতুক দিই। এরপরও তাঁরা ক্ষান্ত হননি। নতুন বাড়ি নির্মাণের জন্যে গত ২৬ জানুয়ারি সজিব ও তার পরিবারের লোকজন মোর্শেদাকে আরও ১০ লাখ টাকা যৌতুক এনে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। কিন্তু আমরা যৌতুক দিতে পারবে না বলে জানালে সজিব ও তার পরিবারের লোকজন মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে। আমরা মেয়ের হত্যাকারীদের বিচার চাই।

 

নিহতের মামা রেজাউল মৃধা অভিযোগ করে বলেন, ভাগনি মোর্শেদা আক্তার হত্যার ঘটনায় মামলা দায়েরের পরও পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা দেখায়নি।  নয়দিন পেরিয়ে গেলেও মামলার কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।  বাধ্য হয়ে আমরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ্যে আনি। এর পরই র‌্যাব দ্রুত পদক্ষেপ নেয় এবং মাত্র দুই দিনের মধ্যে মোর্শেদার স্বামী সজিব খানকে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গাজিপাড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।  তিনি আরও বলেন, “যদি পুলিশ আসামিদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা না নিত, তাহলে তারা প্রথম থেকেই গ্রেপ্তারে উদ্যোগী হতো।  বরং, র‌্যাব আসামিকে গ্রেপ্তার করার পরও পুলিশ ভুয়া দাবি করছে যে তারা সজিবকে গ্রেপ্তার করেছে।  এছাড়া, আদালতে উপস্থাপিত নথিতে সজিবের গ্রেপ্তারের প্রকৃত অবস্থান গোপন করা হয়েছে।” তিনি অভিযোগ করেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এজাহারে বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্য দিয়েছে, যাতে আসামিরা সহজেই মুক্তি পেতে পারে। আমরা এই ঘটনার নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।

 

আদালতে উপস্থাপিত আসামি প্রেরণ কপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সজিব খানকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে র‌্যাব তাকে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গাজিপাড় এলাকা থেকে আটক করে। এ ছাড়াও, নথিতে পুলিশকেই সজিবের গ্রেপ্তারকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা ঘটনাস্থল ও গ্রেপ্তারের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।  এই অসঙ্গতি নিহতের পরিবার ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।

 

পুলিশের আইন ও বিধি অনুযায়ী, আসামি গ্রেপ্তারের স্থান এবং গ্রেপ্তারকারী সংস্থার তথ্য আদালতের নথিতে সঠিকভাবে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। পুলিশ রেগুলেশনস, বাংলাদেশ (PRB) অনুযায়ী, পুলিশকে মামলার সকল তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হয়।  মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধি (CR PC) অনুযায়ী, যেকোনো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির সঠিক তথ্য আদালতে পেশ করা বাধ্যতামূলক।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, যদি র‌্যাব একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে, তাহলে পুলিশের উচিত তা সঠিকভাবে উল্লেখ করা। নাহলে এটি দায়িত্বহীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে গণ্য হতে পারে।

র‌্যাব-১০ এর সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) ও জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার তাপস কর্মকার কেরানীগঞ্জের আলোকে  বলেন, গৃহবধূ মোর্শেদা আক্তার আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলার বিষয়টি জানতে পেরে র‍্যাব-১০ একটি আভিযানিক দল মামলার আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও ছায়া তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে গত বুধবার সকালে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গাজিপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে সজিব খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।  পুলিশের পক্ষ থেকে সজিবকে গ্রেপ্তারের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমি অবগত নই, তাই কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক সুব্রত দাস বলেন, আসামির বর্তমান বসবাসরত ঠিকানা আদালতে আসামি প্রেরণের কপিতে গ্রেপ্তারের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করতে হয়। আমি সেটিই করেছি।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে আসামি প্রেরণের কপিতে নিজের ইচ্ছেমতো তথ্য উল্লেখ করতে পারেন না। এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হবে।