শুভাঢ্যায় মামলার আসামী আ.লীগ নেত্রী পেলেন গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব 

আইন ও আদালত কেরানীগঞ্জ

• ইউএনওর স্বেচ্ছাচারিতা প্রকাশ্যে; প্রত্যাহার চায় জনগণ 

• মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ধরেনা আসামী

 

ঢাকার কেরানীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলারঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আওয়ামী লীগ নেত্রী ও আওয়ামী লীগের সমথর্ককে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এতে শুভাঢ্যা ইউনিয়নে গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী ও ২ নং ওয়ার্ড সদস্য সাথী আলী, আগানগর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ৬নং ওয়ার্ড সদস্য মো. শাহিন ও জিনজিরা ইউনিয়নের মো. রায়হান উদ্দিন।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিনাত ফৌজিয়ার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর ধারা ৩৩, ১০১ ও ১০২ অনুযায়ী প্রশাসক নিয়োগপ্রাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে গ্রাম আদালত পরিচালনার জন্য তিনজনকে গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন জিনজিরা ইউনিয়নে ৬নং ওয়ার্ড সদস্য মো. রায়হান উদ্দিন, শুভাঢ্যা ইউনিয়নে ২নং ওয়ার্ড সদস্য সাথী আলী (বিস্ফোরক মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ও আওয়ামী লীগ নেত্রী) ও আগানগর ইউনিয়নে ৬নং ওয়ার্ড সদস্য মো. শাহিন (আওয়ামী লীগ সমর্থক)।

 

এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে কেরানীগঞ্জের সাধারণ মানুষ ও ছাত্র জনতার মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

 

এদিকে মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৩ অক্টোবর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী হলেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের নাজিরেরবাগ এলাকার বাসিন্দা হাকিম আলী ফরাজীর ছেলে মানির হোসেন (৩৬)। মামলায় ১২৩ জনের নাম এজাহারভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৭০ থেকে ৮০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলেন শুভাঢ্যা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড সদস্য সাথী আলী।

 

স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত বা এজাহারভুক্ত কোনো ব্যক্তি গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হতে পারেন না। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ ধারা ৩৪ অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি যদি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হন বা দণ্ডিত হন, তবে তিনি পদে থাকার যোগ্য নন। গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ ধারা ৭ অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে বা দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে, ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্যকে গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে তার বিরুদ্ধে যদি কোনো ফৌজদারি মামলা থাকে, তাহলে তিনি এ দায়িত্ব পালনের জন্য অযোগ্য বলে গণ্য হবেন।

 

শুভাঢ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা তুর্য জানান, ছাত্র-জনতার উপর হামলায় নেতৃত্ব দেওয়ার পরও আওয়ামী লীগ নেত্রী সাথী আলী এখনও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও অদৃশ্য শক্তির জোরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করছে না। বরং সম্প্রতি তাকে ইউপি সদস্য থেকে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের দোসরদের পুনর্বাসন করার অপচেষ্টা ছাত্র সমাজ রুখে দিবে। অতি দ্রুত সাথী আলীকে ওই পদ থেকে প্রত্যাহার করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শুভাঢ্যা ইউনিয়নের বেগুনবাড়ি এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ইউপি সদস্য সাথী আলী শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে এখনও রয়েছেন। সাথী আলীর নেতৃত্বে তাঁর সহযোগী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া ও কদমতলী এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছাত্র-জনতার উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। অথচ এখন ওই সাথী আলী গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যানের হয়েছেন। এটি কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায়না। শিগগিরই তাকে অপসারণ করে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। আর কেরানীগঞ্জের ইউএনও যদি তাকে প্রত্যাহার না করে তাহলে আমরা সাধারণ জনগণ এই ইউএনওকেই কেরানীগঞ্জের দায়িত্বে দেখতে চাই না।

 

আগানগর এলাকার বাসিন্দা আ: রহিম বলেন, ইউপি সদস্য শাহিন আওয়ামী লীগের দোসর। তার সঙ্গে কেরানীগঞ্জে ছাত্র আন্দোলনে হামলার নেতৃত্বকারীদের ছবি সামাজিকযোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরায় হয়েছে। অথচ এখনও তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, গ্রাম আদালতের বিচারক যদি এমন অসৎ ও অযোগ্য বক্তি হন। তাহলে মানুষ ন্যায়বিচার পাবে কিভাবে?

 

শুভাঢ্যা এলাকার বাসিন্দা ও বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট আবু সেলিম চৌধুরী বলেন, ফৌজদারি মামলার কোনো আসামি গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হতে পারেন না। যদি তিনি এমন পদে দায়িত্ব নেন, তাহলে তিনি স্থানীয় সরকার আইন ও গ্রাম আদালত আইন লঙ্ঘন করবেন, যা প্রশাসনিক ব্যত্যয় এবং বিচারিক স্বচ্ছতার পরিপন্থী। এটি বিচার ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাছাড়া সাথী আলী মেম্বার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের নিয়ে আমার একটি বাড়ি দখল করে রেখেছিল। এর বাইরেও এলাকার মধ্যে অনেক অনিয়মের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

 

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সোহানুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের দোসর সাথী আলীকে গ্রেপ্তার করে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আমরা ভেবে নিবো প্রশাসনও আওয়ামী লীগের দোসরদের পুনর্বাসন করতে চায়। তাঁদের আমরা কখনও সফল হতে দিবে না।

 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেরানীগঞ্জ শাখার আহ্বায়ক আল-আমিন মিনহাজ বলেন, আওয়ামী লীগ নেত্রী সাথী আলীকে সরকারি দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের রক্তের সাথে বেইমানি করা হলো। শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি আমরা কোন অবস্থাতেই মেনে নিবো না। ইতোমধ্যে আমরা বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে অবগত করেছি। তিনি আমাদের বলেছেন, সাথী আলী এজাহারভুক্ত মামলার আসামি সেটি তিনি জানতেন না। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের এই দোসরকে কোন সরকারি দপ্তরের দায়িত্বে বহাল রাখা হলে আমরা সেটি কঠোর হাতে দমন করবো। কেরানীগঞ্জের ছাত্র সমাজ এইসব ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা রুখে দিবে।

 

মামলার বিষয়ে জানতে শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ড সদস্য সাথী আলীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তার মুঠোফোন সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।

 

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম নিশ্চিত করেন যে, সাথী আলী বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তিনি বলেন, “ফৌজদারি মামলার একজন আসামি কীভাবে গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হন, সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না।”

 

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিনাত ফৌজিয়া বলেন, বিকল্প না থাকায় সাথী আলীকে গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি মৌখিকভাবে শুনেছি তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তবে কোনো লিখিত দলিল পাইনি। শুনেছি তিনি মামলাটি থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, “যদি তিনি সত্যিই ফৌজদারি মামলার আসামি হন, তবে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে এবং তাদের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”